The Business Insider

যেভাবে শিমুল এন্টারপ্রাইজ থেকে নাবিল গ্রুপের জন্ম

নাবিল গ্রুপ

কথায় আছে, ছোট ছোট বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তোলে মহাদেশ, সাগর অতল। ছোট্ট শিমুল এন্টারপ্রাইজ থেকে দেশের বৃহত্তম ট্রেড ভেঞ্চার নাবিল গ্রুপের উত্থানের গল্পটা অনেকটা এমনই। পথচলার শুরুটা খুব ছোট আকারে হলেও ধীরে ধীরে বিশাল মহিরুহে পরিণত হয়েছে নাবিল গ্রুপ অব ইন্ড্রাস্টিজ। নাবিল গ্রুপের চেয়ারম্যান জাহান বক্স মন্ডল ছিলেন সামান্য আলু ব্যবসায়ী। তবে সন্তানদের নিয়ে তার স্বপ্ন দেখায় কমতি ছিল না সামান্যতমও। স্বপ্ন বাস্তবায়নে অসামান্য চেষ্টাও করছেন। আশা ছিল, সন্তান অনেক বড় হবে,তার মুখ উজ্জ্বল করবে। ছেলে মো আমিনুল ইসলামকে পড়াশোনাও করিয়েছেন সেভাবেই। মো. আমিনুল ইসলাম কৃষি বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করে  চাকরির পরিবর্তে উদ্যাক্তা হওয়াকেই নিজের ভবিষ্যত হিসেবে বেছে নেন। বাবা জাহান বকস মন্ডলের কাছ থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা নিয়ে ২০০৬ সালে নিজ গ্রাম রাজশাহীর ভেড়াপুরায় ট্রেডিং বিজনেস শুরু করেন। তার স্বপ্ন ছিল বড়, লক্ষ্য ছিল সুদূরপ্রসারী। অক্লান্ত চেষ্টা ও সাধনার মাধ্যমে তিলে তিলে গড়ে তোলেন শিমুল এন্টারপ্রাইজ।    

এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একে একে গড়ে উঠেছে ফ্লাওয়ার মিল, রাইসমিল, ডাল মিল, ফিড মিল, কোল্ড স্টোরেজ, লেয়ার ফার্ম, ক্যাটল ফার্মিং, ট্রেডিং, জুট মিল, সীড ও টিস্যু কালচারসহ মোট ২২টি প্রতিষ্ঠান। দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে এই কোম্পানি।

বর্তমানে বাংলাদেশের  ফুড-কমোডিটি ইন্ডাস্ট্রিতে নাবিল গ্রুপ একটি দ্রুত বর্ধনশীল কোম্পানি। ২০০৬ সালের সেই ছোট্ট ট্রেড ভেঞ্চার এখন বাংলাদেশের দীর্ঘতম কৃষিভিত্তিক শিল্প উদ্যোগের অংশীদার। দেশের উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে কৃষি পণ্য আমদানি, উৎপাদন ও বিপনণে নাবিল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ দৃঢ় ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমানে চারটি মৌলিক খাতে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছে নাবিল গ্রুপ। যেগুলি হলো, ট্রেড ভেঞ্চারস, সার্ভিস ভেঞ্চারস, এগ্রো ও ফুড এন্ড বেভারেজেস। এরই পরিপ্রেক্ষিতে নাবিল গ্রুপ হয়ে উঠেছে দেশের শীর্ষ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম। ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপন করেছে রাশিয়া, ইউক্রেন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, উরুগুয়ে, মায়ানমার এবং ভারতের মতো দেশের সঙ্গে। এছাড়াও নাবিল গ্রুপ আমদানি করছে কয়লা, চুনাপাথর এবং বেলেপাথর।

রাজশাহীর পবা উপজেলার দাওকান্দি গ্রামে অবস্থিত আছে নাবিল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক।

যাতে রয়েছে নাবিল রাইস মিল, ফ্লাওয়ার মিল এবং ডাল মিল। যা বাংলাদেশের মানুষের প্রতিদিনের সুষম খাদ্যের চাহিদা মেটাতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া পোলট্রি খাতেও রয়েছে নাবিল গ্রুপের সমান পদচারনা। মালয়েশিয়ান ও ইটালিয়ান টেকনোলজি সমৃদ্ধ রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার ঝিকাপাড়ায় অবস্থিত নাবিল গ্রুপের নাবা ফার্ম প্রতিদিন উৎপন্ন করে যাচ্ছে ৮ লাখেরও বেশি স্বাস্থ্যকর জৈববান্ধব ডিম।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)সহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী জানা গেছে, তুলনামূলক পিছিয়ে থাকা অঞ্চল রাজশাহীর নাবিল গ্রুপ সর্বশেষ অর্থবছরে (২০২৩-২৪) বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। এ সময়ে গ্রুপটির আমদানিকৃত পণ্যের মোট মূল্য ছিল ১২১ কোটি ডলার। গ্রুপটি এখন বিলিয়ন ডলার বা শতকোটি ডলার ক্লাবের অন্যতম সদস্য। সূত্র অনুসারে, নাবিল গ্রুপের তিনটি কোম্পানি সর্বশেষ অর্থবছরে দেশীয় মুদ্রায় প্রায় ১৩ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা (১২১ কোটি ডলার) মূল্যের পণ্য আমদানি করেছে। এর মধ্যে নাবিল অটো ফ্লাওয়ার মিল আমদানি করেছে ৭ হাজার ১৩৪ কোটি টাকা মূল্যের পণ্য। নাবিল নাবা ফুডস লিমিটেড ৩ হাজার ৮২৯ কোটি টাকার পণ্য আমদানি করেছে। নাবিল ফিড মিলস লিমিটেডের আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য ছিল ২ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা।

ভিত্তিক আমদানির পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে দেশে ৮০ লাখ টন গম আমদানি হয়েছে। নাবিল গ্রুপ মোট গমের ২৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ আমদানি করে সবার শীর্ষে অবস্থান করছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা সিটি গ্রুপ আমদানি করেছে১৪ দশমিক ৬২ শতাংশ গম। তৃতীয় স্থানে থাকা মেঘনা গ্রুপের আমদানির পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ৯৯ শতাংশ। এ সময়ে আকিজ গ্রুপের মাধ্যমে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং আবুল খায়ের গ্রুপের মাধ্যমে ৬ দশমিক ৪০ শতাংশ পণ্য আমদানি হয়েছে। সরকারসহ বাকী আমদানিকারকদের মাধ্যমে আমদানি হয়েছে ৩৪ দশমিক ০২ শতাংশ গম।

আলোচিত সময়ে দেশে মসুর ডালের প্রায় অর্ধেকই আমদানি করেছে নাবিল গ্রুপ।

এ সময়ে ৬ লাখ ৫৭ হাজার টন মসুর ডাল আমদানি হয়েছে। এর ৪৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ আমদানি করেছে নাবিল গ্রুপ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ ডাল আমাদিন করেছে সিটি গ্রুপ। চট্টগ্রামের বিএসএম গ্রুপ আমদানি করেছে ৮ দশমিক ৯০ শতাংশ ডাল। বাকী ২৪ দশমিক ৩১ শতাংশ ডাল আমদানি হয়েছে সরকারি ও বেসরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে।

মটর ডালের ক্ষেত্রে অর্ধেকেরও বেশি আমদানি হয়েছে নাবিল গ্রুপের মাধ্যমে। বছরের প্রথম আট মাসে দেশে মোট ৫ লাখ ৩৯ হাজার টন মটর ডাল আমদানি হয়েছে। নাবিল গ্রুপ আমদানি করেছে মোট মটর ডালের ৫৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ। আকিজ গ্রুপ আমদানি করেছে ১৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ মটর ডাল। বাকী ২৯ দশমিক ৫০ শতাংশ মটর ডাল আমদানি করেছে সরকারি-বেসরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠান।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে দেশে ১৪ লাখ ৫৫ হাজার টন সয়াবিন মিল আমদানি হয়েছে। এর ১৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ আমদানির মাধ্যমে তৃতীয় বৃহৎ আমদানিকারকের অবস্থানে ছিল নাবিল গ্রুপ। সয়াবিন মিলের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক ছিল মেঘনা গ্রুপ। এ গ্রুপের মাধ্যমে আমদানি হয়েছে ২৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ সয়াবিন মিল। সিটি গ্রুপের অংশ ছিল ২০ দশমিক ৪১ শতাংশ।

গবাদী পশু খাতেও পিছিয়ে নেই নাবিল। রাজশাহীর পবা উপজেলার মাহিন্দ্র গ্রামে নাবিল গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করে নাবা ডেইরি এন্ড ক্যাটেল ফার্ম। যেখানে রয়েছে ২৫০০ এর বেশি উন্নত জাতের গরু। যা দেশের মানুষের প্রিমিয়াম মাংস, দুধ এবং দইয়ের চাহিদা মেটাতে কাজ করে যাচ্ছে।

নাবিল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের লক্ষ্য কৃষিখাতে স্বয়ংসম্পন্ন স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ে তোলা। তাই নাবিল গ্রুপের গবেষনা দল নিজস্ব গবেষনাগারে ভুট্টা, টমেটো, বেগুন ও মটরশুটিসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যকর সবজির উন্নত বীজ তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়াও উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে নাবিল তৈরি করেছে উন্নত প্রযুক্তির এগ্রিকালচার গ্রিন হাউজ। যা একটি পরিচ্ছন্ন, স্বনির্ভর ও ইকো ফ্রেন্ডলি বাংলাদেশ উপহার দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।

পথচলার প্রায় দুই দশকে পণ্যের গুনগত মান ছিল নাবিল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের প্রধান শক্তি। যা স্বাস্থ্যকর বাংলাদেশ গড়তে এবং বাংলাদেশের কৃষি খাতকে আরও বহুদূর নিয়ে যেতে কাজ করে যাবে।  

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *